প্রজননক্ষম স্ত্রী ও পুরুষ বাগদা চিংড়ি সংগ্রহের উপযুক্ত সময় হলো মার্চ থেকে নভেম্বর মাস। চিংড়ি সংগ্রহ করে হ্যাচারিতে আনার পর এগুলোকে প্রথম ৪-৭ দিন নির্দিষ্ট ট্যাংকে রেখে অভিযোজিত করা হয়। হ্যাচারিতে আনার পর ২৫-৫০ পিপিএম পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট দ্রবণে এদের জীবাণুমুক্ত করা হয়। পরিপক্ক ট্যাংকের প্রতি বর্গমিটারে ১০০-২০০ গ্রাম ওজনের ২-৭টি চিংড়ি ১:১ (স্ত্রী: পুরুষ) অনুপাতে মজুদ করা হয়। স্ত্রী চিংড়ির ওজন কমপক্ষে ৬৩-৬৮ গ্রাম এবং পুরুষ চিংড়ির ওজন কমপক্ষে ৩৫-৪০ গ্রাম হওয়া উচিত। ট্যাংকের ৬০% পানি প্রতিদিন পরিবর্তন করতে হয়। এসময় চিংড়ির দ্রুত বৃদ্ধির জন্য পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ করা হয়।
পরিপক্ক ট্যাংকে ৭-৮ দিন রাখার পর সন্ধ্যায় পানি কমিয়ে স্ত্রী চিংড়ির ডিম্বকোষের উন্নতি লক্ষ্য করা হয় যা বাইরে থেকেই দেখা যায়। অন্যদিকে পরিপক্ক পুরুষ চিংড়ির পঞ্চম চলনপদের পোড়ায় পুংজনন ছিদ্রে শুক্রকীটের মোড়ক (spermatophores) দেখা যায়। ডিম্বাশয়ের পূর্ণতা নির্ভর করে ডিম্বাশয়ের আকার, রং ও ডিম্বানুর মাপের ওপর। পরিপক্ক স্ত্রী চিংড়ির ডিম্বাশয়কে ৫টি দশায় ভাগ করা যায়।
ক) অপরিণত/অপরিপক্ক পর্যায় (Immature stage): এ অবস্থায় ডিম্বানু খুব ছোট থাকে। ডিম্বাশয় পাতলা ও স্বচ্ছ থাকে। তবুও পিঠের খোলসের ভিতর নিয়ে ডিম্বানু দেখা যায় না। ভিমের গড় আকার ০.০২৮ মিমি হয়।
খ) উন্নয়নশীল পর্যায় (Early developing stage): এ পর্যায়ে ডিম্বাশয় এর পরিপক্কতা শুরু হয়। ডিম্বাশয়ে স্বচ্ছ থেকে হালকা জলপাই রঙের লম্বা ফিতার মত ডিম্বানু দেখা যায় যা খোলসের বাইরে থেকে পরিলক্ষিত হয়। এসময় ডিমের গড় আকার ০.০৭৮ মিমি হয় ।
গ) প্রায় পরিপর পর্যার (Nearly ripe stage): ডিম্বাশয় এর রং ঘন হতে থাকে এবং হালকা নীল বর্ণ ধারণ করে। ডিম্বাশয়ের দুই পার্শ্ব বর্ধিত হয়ে কিছুটা ডায়মন্ড বা প্রজাপতির আকার ধারণ করে। ভিমের গড় আকার ০১৮৮ মিমি হয়।
ঘ) পরিপক্ক পর্যায় (Ripe stage): এ সময় ডিম্বাশয় সম্পূর্ণরূপে পরিপক্কতা লাভ করে। উদর অঞ্চল প্রার সম্পূর্ণ স্থান দখল করে ডিম্বাশয় বর্ষিত হয়। গাঢ় সবুজ রঙের পরিপূর্ণ ভায়ন বা প্রজাপতির আকার ধারণ করে। ডিমের গড় আকার হয় ০.২৩১ মিমি।গ
ঙ) পরিপক্ক পরবর্তী পর্যায় (Spent ripe stage): এ পর্যায়ে ডিম ছেড়ে ডিম্বাশয় পুনরায় প্রথম দশার জাকার ধারণ করে। তবে অনেক সময় আংশিক ডিম ছেড়ে দ্বিতীয় দশার মতো দেখায়। এ পর্যায়ে সাদা রং পরিলক্ষিত হয় তবে স্বচ্ছ নয়। একটি পরিপক্ক স্ত্রী চিংড়ির বছরে ভিন্ন ধারণ ক্ষমতা প্রায় ৩.০ থেকে ৭.৫ লক্ষ।
বাগদা চিংড়ির প্রজনন ক্রিয়া: সম্পূর্ণরূপে পরিপক্ক বাগদা চিংড়ির প্রজনন গভীর সমুদ্রে রাত্রিকালে সম্পন্ন হয়। প্রথমে পুরুষ চিংড়ির ওপর স্ত্রী চিংড়ি সমান্তরালভাবে অবস্থান করে। এরপর একে অপরকে অক্ষীয়দেশ বরাবর আকড়ে ধরে এবং পুরুষ চিংড়ি স্ত্রী চিংড়ির দেহের নিচে সমাপ্তরালভাবে অবস্থান করে। শেষ পর্যায়ে পুরুষ চিংড়ি তার উদরের অংশ বাকিয়ে “ট” আকৃতির বেষ্টনী তৈরি করে। এভাবে তাদের মিলন সংঘটিত হয় যা ৩-৪ মিনিট স্থায়ী হয়।
বাগদা চিংড়ির প্রজনন ক্রিয়া সম্পন্ন হলে স্ত্রী বাগদাকে আলাদা ট্যাংকে স্থানান্তর করা হয়। সাধারণত একটি ট্যাংকে একটি স্ত্রী বাগদা চিংড়িকে অথবা ৩০০ লিটার এর ট্যাংকে ২-৩ টি স্ত্রী বাগদা চিংড়িকে রাখা হয়। স্থানান্তরের পূর্বে নিশ্চিত করতে হয় যে মিলন ঘটেছিল কি-না। স্ত্রী চিংড়ির থেলিকামে স্পার্মাটোফোরের উপস্থিতি দেখে নিশ্চিত হওয়া যায়। এসময় স্পনিং ট্যাংকের পানির তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সে. এর কাছাকাছি রাখা হয়। পানির লবণাক্ততা সাধারণত ২৮-৩০ পিপিটি রাখা হয়। সর্বক্ষণের জন্য একটি বায়ু সঞ্চালন যন্ত্র, তাপমাত্রা পরিমাপক যন্ত্র এবং পানি গরম করার যন্ত্র সংযুক্ত রাখা হয় এবং উপযুক্ত পরিবেশ বজায় রাখা হয়।
সাধারণত রাত ১.০ থেকে ২.০ টার মধ্যে স্ত্রী বাগদা চিংড়ি ডিম ছাড়ে। স্ত্রী চিংড়ি তার তৃতীয় ভ্রমণ পদের গোড়ায় অবস্থিত জননেন্দ্রিয় পথে ডিম ছাড়ে এবং একই সাথে থেলিকাম থেকে শুক্রকীট মুক্ত করে এবং সাঁতারের মাধ্যমে ডিমগুলো ছড়াতে সাহায্য করে। ডিম ছাড়তে ২-৭ মিনিটের মতো সময় লাগে। এরপর স্ত্রী বাগদাকে তুলে অন্য ট্যাংকে স্হানান্তর করা হয় এবং ডিম ফুটতে সময় দেয়া হয়। ১২-১৫ ঘন্টার মধ্যে ডিম ফুটে লার্ভা বের হয়। প্রাথমিকভাবে এসব লার্ভাকে খাবার দেয়া হয় না। এরা ১০-১৫ মিমি আকার ধারণ করার পর এদেরকে লার্ভা ট্যাংকে স্থানান্তরিত করা হয় এবং সেখানে বিভিন্ন ধরনের ফাইটোপ্লাংকটন ও জুপ্লাংকটন খাদ্য হিসেবে সরবরাহ করা হয়।
লার্ভা হলো চিংড়ির ডিম ফুটে বের হবার পর প্রাথমিক দশা। লার্ভা তিনটি স্বতন্ত্র পর্যায় অতিক্রম করে। যথা- নপ্রির ৬টি ধাপ, প্রোটোজোয়াল ৩টি ধাপ এবং মাইসিসের ৩টি ধাপ। নগ্নি থেকে প্রোটোজুইয়া হতে ৪৮ ঘন্টা সময় লাগে এবং মাইসিস হতে ৬ দিন সময় লাগে। এরপর মাইসিস থেকে পোস্ট লার্ভা হতে আরও ৩ দিন সময় লাগে। অর্থাৎ ডিম ফোঁটা থেকে পোস্ট লার্ভা হতে ৯ দিনের মতো সময় ব্যয় হয়। এ পর্যায়ে এদেরকে খাদ্য হিসেবে ফাইটোপ্লাংকটন এবং জুপ্লাংকটন সরবরাহ করা হয়।
ডিমের নিষিক্তকরণ এর পর লার্ভা হয় এবং লার্ভা পরবর্তী দশাকে পোস্ট লার্ভা বলে। প্রজননের সময় থেকে পোস্ট লার্ভা পর্যন্ত পৌছাতে এক মাসেরও বেশি সময় প্রয়োজন। এদেরকে নার্সারি ট্যাংকে প্রতিপালন করা হয়। পিএল-৬ বা পোস্ট লার্ভা ষষ্ঠ দিনে পৌঁছে গেলে এদেরকে কোকুন, ঝিনুক এর মাংসের কিমা খাওয়ানো হয়। দিনে ৩-৪ বার কৃত্রিম খাদ্যের সাথে এসব খাবারের মিশ্রণ তৈরি করে খাওয়ানো হয়। এসময় পানির গুণগত মান বজায় রাখার জন্য ৩০-৪০% পানি প্রতিদিন পরিবর্তন করা আবশ্যক। এতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের ঘনত্ব এবং অ্যামোনিয়ার কম ঘনত্ব (০.১ পিপিএম) এর সম্পৃক্ততা বজায় থাকে। অতিরিক্ত খাদ্য, বিপাকীয় বর্জ্য এবং মৃত শৈবাল অপসারণের জন্য ট্যাংকের নিচে নিয়মিত সাইফনিং এর ব্যবস্থা করা হয়। লবণাক্ততার পার্থক্য ৩-৪ হলে পোস্ট লার্ভা মারা যেতে পারে। তাই লবণাক্ততা ৩০-৩২ পিপিটি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
সাধারণত চিংড়ির লার্ভাকে ফাইটোপ্লাংকটন, জুপ্লাংকটন, ডেট্রিটাস, পলিকেট, ছোট ক্রাস্টেসিয়ান সরবরাহ করা হয়। তবে নগ্নি অবস্থায় এরা খাবার গ্রহণ করে না কেননা তাদের নিজেদের শরীরের কুসুম থলি থেকে তারা পুষ্টি গ্রহণ করে। প্রোটোজোয়া পর্যায়ে খাবার গ্রহণ শুরু হয়। তবে বয়সের সাথে সাথে এদের খাদ্য পছন্দ পরিবর্তিত হয়। প্রাথমিকভাবে এরা ফাইটোপ্লাংকটন পছন্দ করলেও পরবর্তীতে অন্যান্য খাবারের প্রতি আকৃষ্ট হয়। লার্ভার বিভিন্ন খাদ্য তালিকা নিম্নরূপ-
ক) জমাট শুকনো খাদ্য- Spirulina পাউডার (Freeze dried feed)
খ) Microparticulate বা ক্ষুদ্রকণায় পরিণত যৌগিক খাদ্য।
গ) Microencapsulated diet (অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো এসিড সমৃদ্ধ আর্টিমিয়া)।